সাংবাদিকতার আড়ালে শ্যামল দত্ত ‘র’ এজেন্ট ভোরের কাগজের সম্পাদক ছাড়াও একসঙ্গে প্রায় এক ডজন পদ আখড়ে রাখেন
টাকার পাহাড় গড়েছেন তিনি
সাংবাদিকতার আড়ালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইং ‘র’-এর এজেন্টদের মধ্যে অন্যতম এজেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করেছেন শ্যামল দত্ত। তিনি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হিসেবে দেশবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডই নয়; সাংবাদিকতার অপব্যবহার করে শত শত কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। কোটি কোটি টাকা দিয়ে ভোট কিনে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত। এই দিল্লির তাবেদার ছিলেন স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ এ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) তালিকাবদ্ধ ও বেতনভুক্ত একজন সাংবাদিক।
দৈনিক ভোরের কাগজের প্রকাশক সাবের হোসেন চৌধুরী হলেও গত ১৬ বছরে একটি টাকাও নেননি প্রতিষ্ঠানটি থেকে। এই সুযোগে শ্যামল দত্ত পত্রিকাটিতে ৮ম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন দেখিয়ে ডিএফপি তালিকায় ৬/৭ নম্বরে থেকে বিজ্ঞাপন বাণিজ্য এবং স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী লোক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে শত শত কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। ভোরের কাগজ ডিএফপি তালিকায় ৮ম ওয়েজ বোর্ড দেখালেও কর্মরত সাংবাদিক-কর্মচারীদের নামমাত্র বেতন দেয়া হয়। অধিকাংশই সাংবাদিক স্বল্প বেতনে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। শুধু সাংবাদিক-কর্মচারীদের ঠকিয়ে অর্থ আত্মসাত করেছেন তা নয়। এই তথাকাথিত প্রগতিশীল সাংবাদিক ও ‘র’ এর এজেন্ট দোহাই দিয়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও নিয়োগ বাণিজ্য করে শত শত কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। ভোরের কাগজ সম্পাদকই নয়; শ্যামল দত্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাগিয়েছিলেন এক ডজন পদ।
জানা যায়, শ্যামল দত্ত জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। যেখান থেকে অর্থ আত্মসাতের কারণে পদ ছাড়তে হয়েছে। ছিলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার পরিচালক। লোভনীয় এই পদে থেকে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানাবিধভাবে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন। এখানেই শেষ নয়; ছিলেন ক্যাপিটাল মার্কেট স্টেবিলাইজেশন ফান্ডের বোর্ড অব গভর্নরস-এর সদস্য। এর মাধ্যমে শেয়ারবাজারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ-সুবিধা ও মার্কেট ম্যানিপুলেশন করে হাতিয়েছেন বড় অঙ্কের অর্থ। এছাড়া বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর বিভিন্ন নিয়োগ বোর্ডসহ ছিলেন ওখানকার নীতিনির্ধারক। সর্বশেষ বিএসইসি’র একটি নিয়োগের ভাইভা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। আওয়ামী দালাল এবং ‘র’-এর এজেন্ট হওয়ায় পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমই’র জুরী বোর্ডসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। বিভিন্ন সরকারি সংস্থার বোর্ড সদস্যসহ তিনি দাতা সংস্থা ওয়াটারএইডের একজন পরামর্শদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া ছিলেন স্বৈরাচার হাসিনার গবেষণা সেল সিআরআই’র বেতনভুক্ত একজন সাংবাদিক। ওখান থেকেও মাসে ২ লাখ টাকা পেতেন শ্যামল দত্ত।
টাকার কুমির : সাংবাদিক ও ‘র’ এজেন্ট হওয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে আওয়ামী দুঃশাসনের সময়ে শ্যামল দত্ত গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তিনি যেন টাকার কুমির। ঢাকার কাকরাইলের কর্ণফুলী টাওয়ারে আলিশান ফ্ল্যাট, গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ করে আলীশান বাড়ি নির্মাণ, ঢাকার উত্তরা, পূর্বাচল ও সাভারে প্লট, ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি মদের বার, অপরিচিত এক আত্মীয়ের নামে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি গার্মেন্টস, বড় মেয়ে সুষমা শশী দত্ত দেশের বাইরে অষ্ট্রেলিয়ার একটি নামি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। মেয়ের পড়ালেখার কারণে এবং ওখানে থাকার সুবিধার্থে অষ্ট্রেলিয়ায় ফ্ল্যাট ক্রয় ও বড় অঙ্কের অর্থ পাচার করেছেন বলেও সূত্র জানিয়েছে। স্ত্রী সঞ্চিতা কনা ও সন্তানদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর রয়েছে। এছাড়া পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে রয়েছে একাধিক আলিশান বাড়ি। শ্যামল দত্ত ঢাকা ক্লাবসহ রাজধানীর অধিকাংশ রাজকীয় ক্লাবের সদস্য।
নামাজে নিষেধাজ্ঞা : শ্যামল দত্ত একজন ইসলাম বিদ্বেষী হিসেবে ভোরের কাগজে মুসলমান স্টাফদের নামাজ পড়ার ক্ষেত্রেও ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক বাধা সৃষ্টি করেছেন। জামায়াতে নামাজ তো নিষিদ্ধই, এমনকি পবিত্র রমজান মাসেও স্টাফদের একা একা নামাজ পড়ায়ও নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতেন। অবশ্য ভোরের কাগজে অঘোষিত মালিক বা সম্পাদক হিসেবে ক্ষমতার দাপট দেখাতেন বা নিয়ন্ত্রণ ছিল তার স্ত্রী সঞ্চিতা দত্ত কনার কাছে। ভোরের কাগজের অধিকাংশ বিষয়গুলো দেখভাল করেন তার স্ত্রী সঞ্চিতা। এ জন্য প্রতিমাসে স্ত্রীর নামে ৮০ হাজার টাকা নিতেন শ্যামল দত্ত। ভোরের কাগজে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংবাদিক জানান, শ্যামলের স্ত্রী সঞ্চিতা দত্ত কনা পত্রিকার এক সিনিয়র রিপোর্টারকে ফোন করে অফিসে জামায়াতে নামাজ না পড়ার পরামর্শ দেয়ার ধৃষ্টতা দেখান। প্রতিষ্ঠানটির অনেক স্টাফ প্রতিষ্ঠানে নামাজ পড়তে অস্বস্তি বোধ করতেন। সাংবাদিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার বেতন কত দেয়া হবে তা নির্ধারণ করতেন এই সঞ্চিতা কনা। কাকে ইনক্রিমেন্ট দিবেন, কাকে দিবেন না সেটাও তার ওপর নির্ভর করতো। বাধ্য হয়েই স্টাফরা শ্যামল দত্তের স্ত্রীর সঙ্গে সবাই যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন বা আস্থায় রাখতে নানাভাবে সম্পর্ক রাখতেন। ভোরের কাগজে কখনোই কাজের মূল্যায়ন করা হতো না। শুধুমাত্র যারা আওয়ামী লীগের দালালি করতেন তাদেরই সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হতো। তাদেরকে স্পেশাল নজরে রাখা হতো।
ভোরের কাগজ সূত্রে জানা যায়, ভোরের কাগজ থেকে সম্পাদক হিসেবে তিনি প্রতিমাসে তিন লাখ টাকার মতো বেতন পেলেও মাসে শ্যামল দত্তের পেছনে ব্যয় প্রতিমাসে প্রায় দশ লাখ টাকা। এমনকি তার ঢাকা ক্লাবের সেলুনে চুল কাটার টাকা, বিভিন্ন হোটেলে রাতের মদের বিল এবং তার বাসার বুয়ার কাজের বিল পর্যন্ত ভোরের কাগজের ফান্ড থেকে দেয়া হতো। এছাড়া বিদেশ ট্যুর থেকে শুরু করে দেশের যে কোনো জায়গায় ব্যক্তিগত ভ্রমণে গেলেও এর সম্পূর্ণ খরচ বহন করা হতো ভোরের কাগজ থেকে। ভোরের কাগজের মালিক সাবের হোসেন চৌধুরী (আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী) পত্রিকাটির মালিক হলেও তিনি গত দুই দশক এর কোনো খোঁজখবর রাখেননি। আর এই সুযোগে শ্যামল দত্তই পত্রিকাটিকে ব্যবহার করে প্রায় শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এদিকে শ্যামল দত্ত প্রতিমাসে একাধিকবার বড় অঙ্কের অর্থ পাঠাতেন অস্ট্রেলিয়ায়। বড় মেয়ে শশীর পড়া-লেখার সুযোগ নিয়ে এই অর্থ পাচার করেছেন অষ্ট্রেলিয়ায়। ভোরের কাগজের হিসাব বিভাগে খোঁজ নিলেও মিলবে অস্ট্রেলিয়ায় টাকা পাচারের অনেক তথ্য। সূত্র আরো জানায়, শ্যামল দত্ত পত্রিকাটিকে ব্যবহার করেছেন বিএনপি-জামায়াতবিরোধী আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবে। বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে যা খুশি তা লিখতেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিপোর্টারদের দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক অনেক রিপোর্ট করাতেন। বিএনপি-জামায়াতকে জনমনে হেয়প্রতিপন্ন করতে এই পত্রিকাটিকে মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত জুলাই-আগস্টের নিউজগুলো দেখলে প্রমাণ পাওয়া যাবে। এই পত্রিকাটি ভারতের ‘র’ এর মুখপাত্র হিসেবেও ব্যবহার করতেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে যাওয়ার পর শ্যামল দত্ত প্রথমে স্ত্রী-কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে আখাউড়া বর্ডার দিয়ে মোটা অংকের টাকা দালালদের দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এলাকাবাসী চিনতে পেরে খবর দিলে বিজিবি তাকে আটক করে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। অতঃপর গত ১৬ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের ধোবাউড়া সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবুসহ গ্রেফতার হন। বর্তমানে তিনি ডিবিতে রিমাণ্ডে রয়েছেন।