মেজর পরবর্তীতে লে:কর্নেল শরিফুল হক ডালিম (যিনি মেজর ডালিম হিসেবে বেশি পরিচিত) ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত থাকা অবস্থায় এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পালিয়ে ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন।মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহসিকতা, বীরত্ব ও কৃতিত্বের জন্য তিনি  "বীর উত্তম" খেতাবে ভূষিত হন।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংস ও নির্মম হত্যাকান্ডে তিনি  সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবরটি তিনি নিজেই বাংলাদেশ বেতারে ঘোষণা দেন।
     ১৯৭৬ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত হওয়ার পর বিভিন্ন দেশে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৯৫ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় অন্যান্যদের সাথে তাঁকেও  মৃত্যুদন্ডাদেশ দেওয়া হয়।তবে তিনি এখনো পর্যন্ত  বিদেশে পলাতক রয়েছেন।তাঁর বিরুদ্ধে ইন্টারপোল কর্তৃক গ্রেফতারী পরোয়ানা জারীকৃত আছে।তাঁর পিতা জনাব সামছুল হক একজন রাজনীতিবিদ ও এম,পি ছিলেন।
     সম্প্রতি প্রবাসী সাংবাদিক জনাব ইলিয়াস হোসেনকে দেয়া তাঁর এক স্বাক্ষাৎকার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে ।সাম্প্রতিককালে এটি লক্ষ লক্ষ Views হয়েছে। উক্ত স্বাক্ষাৎকারে প্রদত্ত বক্তব্যের উপর ইতোমধ্যে অনেকেই  মতামত প্রকাশ, মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করছেন। তাঁর প্রদত্ত বক্তব্যে বেশ কিছু বিষয়ের সত্যতা উন্মোচিত হয়েছে,অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।আবার কিছু কিছু বিষয়ে বিতর্ক এবং সংশয় রয়ে গেছে। অধিকন্তু বিগত ৫০ বছরে প্রচলিত কিছু ধারণা ও ভুল বুঝাবুঝির অবসান বা নিষ্পত্তি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তাঁর বক্তব্য অনুসারে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের কর্তৃত্ব ও বিদ্বেষমূলক আচরণের সত্যতা এদেশের জনগণ ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছে।আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে  ভারতের আন্তরিক সমর্থন ও সহায়তা কখনো ভুলবার নয়।এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্বীকৃত অংশ।স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিতর্কিত আচরণ ও কিছু কিছু পদক্ষেপ আমাদেরকে মর্মাহত করেছে।একটি ক্ষুদ্র প্রতিবেশী রাষ্ট্র  হিসেবে এদেশের জনগণের কাছে বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে নিকট এসব আচরণ ছিল অনাকাঙ্ক্ষি। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত সর্বদাই নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে যা ইতোমধ্যে তাদের কাজকর্মে দৃশ্যমান হয়েছে।তাদের আচরণ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বন্ধুভাবাপন্ন,আবার অন্য দলের সরকারের সময়ে বিমাতৃসুলভ।দু'দেশের সরকারের সাথে সম্পর্ক হওয়া উচিৎ সৌহার্দপূর্ণ, কোন দলের সাথে নয়। এসব প্রেক্ষাপটে এদেশের মানুষ মনে করে তারা বাংলাদেশকে কখনো আন্তরিকভাবে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। 
     মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সেনা পরিষদ গঠন,শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শপথ ভঙ্গ,পঁচাত্তরের পনের আগস্টকে বিপ্লব বলা এসব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।যু্দ্ধকালীন সময়ে সেনা পরিষদ গঠনের বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।কেননা তখন দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির কোন নিশ্চয়তা ছিল না।এই বিষয়টি অতীতে কখনো কোন উৎস থেকে প্রচারও হয়নি এবং এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণও আছে বলে প্রতীয়মান হয় না।এ ধরণের কিছু হলে উহা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা "র" এর গোচরীভূত হতো এবং জড়িতদের পক্ষে ঐ সময়ে  ভারতে অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে পড়তো। ডালিম সাহেব নিজেও যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য "বীর উত্তম" খেতাবে ভূষিত হন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শপথ ভঙ্গের বিষয়টিও সঠিক বলে ধরে নেয়া যায় না।জনাব ডালিমের ভাষ্যমতে শহীদ জিয়া অত্যন্ত সৎ ছিলেন।যুদ্ধকালীন অবস্থায় একজন সৎ কর্মকর্তা,বীর মুক্তিযোদ্ধা,ফোর্স কমান্ডার('জেড ফোর্স'-এর অধিনায়ক)গোপনীয়ভাবে এ ধরণের  বিতর্কিত কাজকর্মে সম্পৃক্ত হবেন এটা  বিশ্বাস করার কোন অবকাশ নেই। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তিনি সিনিয়র হওয়া সত্বেও তৎকালীন সরকার তাঁকে সেনা প্রধান করেনি।তারপরও তিনি জুনিয়রের অধীনে উপ সেনা প্রধান হিসেবে তিন বছর চাকরি করেছেন।এর জন্য তৎকালীন সরকারের প্রতি কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মর্মে শোনা যায়নি। এতে বুঝা যায় তিনি চাকরি শৃংখলার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এবং সরকার তথা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট অনুগত ছিলেন। শপথ ভঙ্গের দাবী সত্য হলে তিনি স্বাধীনতার পর মেজর ডালিমকে চাকরিতে বহাল রাখা এবং বীরত্বের জন্য পুরস্কার প্রদানে বিরোধিতা করতে পারতেন।যুদ্ধের সময়ে বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী ছিলেন।জনাব ডালিমের ভাষ্যমতে বাহাত্তর সালে বঙ্গবন্ধু মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত  মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তিনি কিছুই অবহিত ছিলেন না।কাজেই  যুদ্ধকালীন ভারতের সাথে কথিত গোপন চুক্তির বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর সম্পৃক্ততার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।পঁচাত্তরের পনের আগস্টে সংঘটিত ঘটনাকে কোন বিপ্লব বা সামরিক অভ্যূত্থান হিসেবে আখ্যায়িত করার সুযোগ নেই ।কারন এতে উচ্চ পর্যায়ের কোন সামরিক কর্মকর্তা নেতৃত্ব দেননি এবং পুরো সামরিক বাহিনীর সমর্থনও ছিল না। তাছাড়া জনগণও তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে রাস্তায় নেমে আসেনি।কিছু সংখ্যক জুনিয়ার সেনা অফিসার তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে স্বপরিবারে হত্যা করেছিল।বিগত ৫০ বছর যাবত প্রচার ছিল বঙ্গবন্ধুর ছেলে জনাব ডালিমের স্ত্রীকে লাঞ্চনা করার কারনেই তিনি বিক্ষুদ্ধ হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য হত্যাকারীদের দলে যোগ দিয়েছিলেন।জনাব ডালিমের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটা যে মিথ্যা অপপ্রচার ও ভুল ধারণা সেটা প্রমানিত হলো।
     অনেকেই মনে করেন বঙ্গবন্ধু জনমত না নিয়ে নিজেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাষ্ট্রপতি ঘোষণা ও এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে ভুল করেছিলেন।কারন সারাজীবন গণতন্ত্র ও ন্যায্যতার জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে তাঁকে অনেক জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে।ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন, রক্ষী বাহিনী গঠন করে মানুষের উপর নির্যাতন, দূর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট,দুর্ভিক্ষ  ও বাক স্বাধীনতা হরণ ইত্যাদি বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা হ্রাসের অন্যতম কারন বলে মনে করা হয়। অপরদিকে মাননীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত পনের বছর জনগণের ভোটাধিকার ও বাক স্বাধীনতা হরণ করে নিজের ইচ্ছে মতো দেশ শাসন করেছেন।জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য তিনিও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘসময় আন্দোলন ও সংগ্রাম করেছিলেন।অথচ ক্ষমতায় গিয়ে ভোটাধিকার হরণ করে নিজেই স্বৈরাচার হিসেবে আবির্ভুত হন। অনেকের মতে উল্লিখিত ভুলের জন্য হয়তো পিতা ও কন্যাকে করুন পরিণতির দিকে যেতে হয়েছে। 
       বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, অত:পর লক্ষাধিক শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন। উক্ত ঐতিহাসিক গৌরবময় ঘটনাগুলো আমাদের ইতিহাসের অন্যতম অংশ।এগুলো বাংলাদেশের জন্ম ও অস্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত।এসবকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।অতীতে যারা জনগণের উপর অত্যাচার, নির্যাতন এবং স্বৈরশাসন চালিয়ে দেশকে ধ্বংসস্তুূপে পরিণত করেছে অবশ্যই তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত বিচার হোক।কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি ও গৌরবময় অধ্যায়কে অগ্রাহ্য করে নয়।রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরসমূহের সংস্কার অপরিহার্য।বিদ্যমান ব্যবস্থা বহাল থাকলে স্বৈরাচারী শাসনের পুনরাবৃত্তি ঘটা অমূলক নয়।আমাদের ভাষা,স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন, গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর পরবর্তী সরকারসমূহের স্বৈরাচারী শাসন ও ঘটনা প্রবাহ ইত্যাদিতে যার যতটুকু অবদান বা ভুমিকা সেটা নিশ্চয় ইতিহাস মূল্যায়ন করবে ।
(লেখক একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কলামিস্ট)।