মহার্ঘ ভাতা যা সাধারণভাবে সরকারি কর্মচারীদের নিকট ইংরেজীতে Dearness Allowances হিসেবে পরিচিতি।আভিধানিকভাবে মহার্ঘ একটি ভিন্নার্থক শব্দ।এ শব্দটি সরকারি চাকরিজীবীদের কাছে 'বিশেষ আর্থিক সুবিধা' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ক্ষমতার পট পরিবর্তন বা অন্য কোন কারনে দ্রব্যমূ্ল্যের উর্ধ্বগামী,মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদির জন্য সরকারি কর্মচারীদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সংসার ব্যয় নির্বাহ দুষ্সাধ্য হয়ে পড়ে।ফলে সরকার প্রণোদনা বিবেচনায় মূল বেতনের নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ  মহার্ঘ ভাতা হিসেবে প্রদান করে থাকে।এ প্রথা বহু বছর যাবত প্রচলিত। 
     গত ২০১৫ সালে সরকার গঠিত বেতন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে  নতুন জাতীয় বেতন গ্রেড কার্যকর করা হয়।বেতন কমিশনের সুপারিশের মধ্যে আরো কতিপয় সুপারিশ ছিল যা বাস্তবায়িত হয়নি।২০০৯ সালে জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকরের  ০৬ বছরের মধ্যে উল্লিখিত বেতন গ্রেড প্রদান করা হয়েছিল।এ বেতন গ্রেডের মাধ্যমে সরকারি চাকরির বিভিন্ন পদে ভালো অঙ্কের বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়।যৌক্তিকভাবে বেতন বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্মচারীগণও এতে খুশি হয়েছিল।উক্ত বেতন স্কেল কার্যকর হওয়ার পর ইতোমধ্যে  প্রায় ১০ বছর অতিবাহিত হয়েছে।স্বাধীনতার পর নতুন বেতন স্কেল প্রদানে অতীতে এতো দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ হয়নি।অতীতে ১৯৭৩,১৯৭৭,
১৯৮৫,১৯৯১,১৯৯৭,২০০৫,২০০৯, ও ২০১৫ সালে নতুন জাতীয় বেতন স্কেল  প্রদান করা হয়েছিল।অবশ্য মুদ্রাস্ফীতির কারনে ২০২৩ সালে মূল বেতনের ৫% হিসেবে প্রণোদনা প্রদান করা হয়।

       ২০১৫-২০২৫ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় ইতোমধ্যে মুদ্রাস্ফীতি অনেক বেড়েছে।দ্রব্য মূল্য  উর্ধ্বগামী(যদিও শীতকালীন শাক-সবজির ব্যাপক ফলনের কারনে বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকায় দাম অনেকটা কম) বিশেষ করে চাউল,ভোজ্য তেল, পোশাক পরিচ্ছদ,এলপি গ্যাস,পানি,বিদ্যূৎসহ নিত্য ব্যবহার্য পণ্য সামগ্রীর মূল্য অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্মচারীদের পক্ষে  প্রাপ্ত বেতন ভাতাদির ভিত্তিতে পরিবার খরচ মিটানো খুবই কষ্টসাধ্য  হয়ে দাঁড়িয়েছে।২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ২,৫০,৫০৬ কোটি টাকা এবং ২০২৪- ২০২৫ অর্থ বছরে তা ৭,৯৭,০০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয় অর্থ্যাৎ  বিগত ১০ বছরে বাজেটের আকার তুলনামূলকভাবে ০৩ গুন বৃদ্ধি পেয়েছে।উক্ত ১০ বছরের মধ্যে দেশীয় মুদ্রার বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্যও প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি বেড়েছে।চাউল,ভোজ্য তৈল,ডাল, চিনিসহ নিত্য ব্যবহার্য পণ্য সামগ্রী এবং গ্যাস,পানি,বিদ্যূতের মূল্য গড়ে ৩/৪ গুন বেড়ে গেছে। কর্মচারীদেরকে প্রতি বছরে মূল বেতনের ৫% হিসেবে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট প্রদান করা হলেও গত ১০ বছরে তাঁদের মোট ৬০-৭০% বেতন বৃদ্ধি হয়েছে।আবার যেসব প্রবীণ কর্মচারীর মূল বেতন গ্রেডের শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে তাঁদের বাৎসরিক ইনক্রমেন্ট প্রাপ্তির কোন সুযোগ নেই। কাজেই তাঁদের কোন বেতন-ভাতা বাড়বে না।এ প্রেক্ষাপটে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি প্রত্যাশা করা অন্যায় কিছু নয় বলে প্রতীয়মান হয়।মহার্ঘ ভাতা একটি অন্তরবর্তীকালীন আর্থিক সুবিধা যা মূল বেতনের সাথে যুক্ত হয় না এবং অবসর কালে কোন অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া যায় না।এটি নতুন বেতন গ্রেড প্রবর্তনকালে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
      বর্তমান সরকার কর্মচারীদের দু:খ-দুর্দশা লাঘবে মহার্ঘ ভাতা প্রদানের জন্য একটি কমিটি গঠণ করে।জানা যায় কমিটি ইতোমধ্যে যৌক্তিক  সুপারিশমালাও সরকারে নিকট পেশ করেছে।মহার্ঘ ভাতা প্রদানের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কমিটি গঠণের পর নানা পক্ষ থেকে বিরোধিতা শুরু হয়।অনেকে মতামত দিচ্ছেন যে, মহার্ঘ ভাতা প্রদান করা হলে দ্রব্য মূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি  আরো বৃদ্ধি পাবে,বেসরকারি পর্যায়ের কর্মজীবীদের বেতন বৃদ্ধি না পাওয়ায় তাঁরা সমস্যার সম্মুখীন হবেন।আবার অনেকেই বলছেন যে,উপ সচিবগণ বেতন ভাতা ব্যতীত গাড়ি কেনার জন্য বিনা সুদে ত্রিশ লাখ টাকা ও গাড়ি রক্ষণাবেক্ষনের জন্য প্রতি মাসে বাড়তি পঞ্চাশ হাজার টাকা পাচ্ছেন। কাজেই মহার্ঘ ভাতা প্রদান অনুচিত। উপ-সচিবগণ ৫ম গ্রেডের কর্মকর্তা। সিংহভাগ সরকারি কর্মচারী ১২-২০ গ্রেডভুক্ত। তাঁদের বেতন-ভাতাদি উপ সচিব থেকে অনেক নিম্নে।আবার উপ সচিব ব্যতীত সরকারের অন্যান্য ৫ম গ্রেডের কর্মকর্তাগণ উল্লিখিত গাড়ি সুবিধা থেকে বঞ্চিত।তৎকালীন সরকার প্রশাসন ক্যাডারকে নিজেদের আয়ত্তে রাখা এবং বিনা ভোটে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার জন্য এই অন্যায্য সুবিধা প্রদান করেছে মর্মে অনেকেই মনে করে।একসময়ে সরকারি চাকরি থেকে বেসরকারি চাকরি আকর্ষণীয় ও বেতন ভাতা তুলনামূলক বেশি ছিল।সেজন্য সরকারি সেক্টরে উপযুক্ত ও মেধাবী কর্মচারীর অভাব দেখা দেয়।যার ফলে ২০১৫ সালে সরকারি চাকরিতে যৌক্তিকভাবে বেতন ভাতা বৃদ্ধি করা হয়।এখনো ব্যাংকে একজন প্রবেশনারী অফিসার ৫০-৬০ হাজার টাকা বেতন পান।অন্যদিকে বিসিএস ক্যাডারসহ একজন প্রথম শ্রেণির ৯ম গ্রেডের কর্মকর্তা সর্বসাকুল্যে  ৩৫-৩৭ হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন।সাধারণত: দেখা যায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি পেলে তার আলোকে বেসরকারি সেক্টরেও মোটামুটি বৃদ্ধি পায়।সরকারি সকল দপ্তরে ঘুষের সুযোগ নেই। আবার অনেক কর্মচারী ঘুষের দাঁড়ে কাছেও নেই। সরকারের কয়েকটি সেক্টরে অফিস সহায়ক থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত দূর্নীতিতে নিমজ্জিত। তবে তাঁদের সাথে অন্যান্যদের তুলনা করা অনুচিত।যাঁরা সততা,স্বচ্ছতা ও  নিষ্ঠার  সাথে দায়িত্ব পালন করেন  তাঁরা সরকার থেকে বৈধভাবে  'বিশেষ আর্থিক সুবিধা' প্রাপ্তির প্রত্যাশায় কত টাকা পাবেন এবং কোন খাতে ঘাটতি পূরণ করবেন তা নিয়ে প্রতিদিন হিসাব নিকাশে লিপ্ত থাকেন।তাই জানুয়ারী থেকে মহার্ঘ ভাতা প্রাপ্তির প্রতীক্ষায় রয়েছে অনেক সৎ ও নিরীহ কর্মচারী। এখন যদি সরকার বিষয়টি বিবেচনা না করে তাহলে এইসব কর্মচারীগণের আশাহত, মনোবেদনা ও দীর্ঘশ্বাসের কারন হয়ে উঠবে।আশাকরি বিদ্যবান বাজার পরিস্থিতির নিরিখে সরকার সদয় হয়ে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের আর্থিক সংকটের বিষয়টি সহানুভূতির সহিত বিবেচনা করবে।কারন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা সারাজীবন দরিদ্র, সুবিধা বঞ্চিত ও নিম্ন আয়ের মানুষকে নিয়ে কাজ করেছেন।তিনি তাঁদের মনোবেদনা ও যন্ত্রণা ভালোভাবেই অবহিত আছেন।
(লেখক একজন অবসরপ্রাপ্ত  সরকারি কর্মকর্তা ও কলামিস্ট)।