আমাদের দেশ দূর্নীতির সূচকে একাধিকবার শীর্ষস্থান লাভ করলে এর ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০০৪ সালে জাতীয় সংসদে দূর্নীতি দমন কমিশন আইন পাস হয়।

উক্ত আইন অনুসারে মহামান্য রাষ্ট্রপতি একজন বিচারপতির নেতৃত্বে দূর্নীতি দমন কমিশন গঠন করেন।গঠিত কমিশন সাবেক দূর্নীতি দমন ব্যূরোর জনবল যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে  কমিশনের সাথে একীভূত করে কার্যক্রম শুরু করে।কমিশনের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর মানুষের মধ্যে দূর্নীতি নির্মূলে আশার আলো সৃষ্টি এবং দূর্নীতিবাজদের মধ্যে ভীতিও সঞ্চার হয়।কারন ২০০৪ সালের আইনে কমিশনকে পর্যাপ্ত ও সীমাহীন ক্ষমতা প্রদান,স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়।জনগণের প্রত্যাশা ছিল দূর্নীতি দমনে কমিশন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে এবং দেশ ক্রমান্বয়ে দূর্নীতির কবল থেকে মুক্ত হবে।
       স্বাধীন দূর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রম শুরু হলেও দূর্নীতি দমনে জাতি তেমন কোন কার্যকর অগ্রগতি দেখতে পাইনি।অতীতে সকল সরকারের সময়ে কমিশনের শীর্ষ পর্যায়ে পছন্দের লোক নিয়োজিত করে তাঁদের মাধ্যমে কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।কমিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে চেয়ারম্যান পদে একজন বিচারপতি এবং একজন সাবেক সেনাপ্রধান ব্যতীত অন্যান্য সময়ে প্রশাসন ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত  কর্মকর্তাগণ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন।কমিশনের সচিব, মহাপরিচালক ও অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের বেশিরভাগ  পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাগণকে প্রেষণে নিয়োজিত করা হয়।বিগত সরকার কমিশনে অশুভ বলয় সৃষ্টি করে কমিশনকে অকার্যকর ও সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সর্বদাই সচেষ্ট ছিল।বিশেষ করে সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া কমিশনের পক্ষে  প্রভাবশালী কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। আবার কমিশনের মাধ্যমে সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে হয়রানি করতেও দেখা যায়।অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের ব্যাপারে আলোচিত অভিযোগ কমিশন অনুসন্ধান করলেও পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট অভিযোগ প্রমানিত হয়নি মর্মে নিষ্পত্তি করা হয় বলে জানা যায়। বিগত সরকারের অনাহূত ও অবৈধ  হস্তক্ষেপ দূদক'কে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। বড় বড় দূর্ণীতিবাজসহ সাবেক আইজিপি জনাব বেনজির আহমদের শত কোটি টাকার ধন সম্পদের সুনির্দিষ্ট তালিকা পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরেও দূদক নিরবতা পালন করায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়।তখন দূদক থেকে বলা হয়েছিল তাঁরা অভিযোগ না পাওয়ায় ব্যবস্থা নিতে পারছে না।দূর্নীতির সুনির্দিষ্ট বিবরণ ও প্রমানক প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার পরেও পদক্ষেপ নিতে বিলম্বিত করার যৌক্তিকতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমদের নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক উচ্চ বিলাসী দূর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তার অনৈতিক কাজকর্মের জন্য পুরো পুলিশ বাহিনী কলঙ্কিত হয়েছে। পুলিশের মনোবল ও মোরালিটি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।অথচ স্বাধীনতা সংগ্রামে এ বাহিনীর সদস্যগণ সর্বপ্রথম জীবন উৎসর্গ করে গৌরবময় ভুমিকা পালন করেছিল।এসব চরম দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দূদক তাৎক্ষনিকভাবে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। বিভিন্ন গোষ্ঠী সরকারের ছত্রছায়ায় দূর্নীতির মাধ্যমে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করলেও কমিশনের পক্ষে প্রতিরোধ বা প্রতিকারে কোন ভুমিকা রাখা সম্ভব হয়নি। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর জ্ঞাত আয় বহির্ভূত বিপুল ধন, সম্পদের মালিক হলেও দূদক এসব রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে  কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে বিরত ছিল।ছোট খাটো দূর্নীতির এবং নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে  মামলা করে অধিক সংখ্যক মামলা দেখানোর মাধ্যমে দূদকের তৎপরতা সীমাবদ্ধ ছিল বলে অনেকেই মতামত ব্যক্ত করে।
         সম্প্রতি  দুদকের একজন সাবেক কমিশনারের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার ধন-সম্পদ অর্জন ও অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে একাদিক গাড়ি ব্যবহারসহ অনৈতিক ভাবে অন্যান্য সুবিধাদি গ্রহণ করেছেন।উত্থাপিত  অভিযোগগুলো মারাত্মক। খবরে জানা যায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ায় দূদক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে।এতে প্রতীয়মান হয় দূদকের নীচের থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত অনেকেই  দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।তাঁদের বিরুদ্ধে হয়তো অভিযোগের অভাবে কোন ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে না। দূর্নীতি প্রতিরোধে দূদক থেকে শুদ্ধি অভিযান শুরু করা উচিত।দূদকের সকল কর্মকর্তা - কর্মচারী শতভাগ দূর্নীতিমুক্ত,সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ হবেন এবং স্বচ্ছতার সাথে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন এটাই জনগণ কামনা করে। ইতোমধ্যে নতুন কমিশন গঠিত হয়েছে।কমিশনের মাননীয় চেয়ারম্যান তাঁর সম্পদের বিবরণ  প্রকাশ করেছেন। এটাকে স্বচ্ছতার প্রতীক ও ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।আশা করা যায় মাননীয় চেয়ারম্যানকে অনুসরণ করে অন্যান্য কমিশনার মহোদয়গণও তাঁদের সম্পদের বিবরণ জাতির কাছে প্রকাশ করবেন।স্বচ্ছতার স্বার্থে দূদকে নিয়োজিত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নিয়ে নিরপেক্ষভাবে যাচাই-বাছাই করা আবশ্যক। এতে দুদকের প্রতি জনগণের ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি  হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীগণও দূর্নীতিমুক্ত থাকতে সচেষ্ট হবেন এবং স্বচ্ছতার সাথে অর্পিত দায়িত্ব পালনে উৎসাহী হবেন।দূদকের কর্মকর্তা - কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হলে  তাঁদের ক্ষেত্রেও অন্যান্যদের ন্যায় একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা সমীচীন হবে ।দূদকের দায়িত্ব দূর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ করা। দূর্নীতি বা যে কোন প্রকার অনিয়মে সম্পৃক্ত হওয়া এটা তাদের জন্য অমার্জনীয় অপরাধ।জনগণ প্রত্যাশা করে দূদকের কর্মকর্তাগণ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে ন্যায্যভাবে অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্য সম্পন্ন করবেন।তাদের এমন কিছু করা সমীচীন হবে না যাতে প্রকৃত অপরাধী রেহাই বা নিষ্কৃতি পাবে আর নিরাপরাধ মানুষ জেল খাটবে। দূদক আন্তরিক হলে এবং কাজে গতিশীলতা ফিরলে অধিকন্তু স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেলে দূর্নীতি অনেকাংশে হ্রাস পাবে। জনগণ দূদককে দন্তহীন বাঘ হিসেবে দেখতে চায় না বরং সবল বাঘ হিসেবে থাবা দিয়ে দূর্নীতি নির্মূলে কার্যকর ভুমিকা পালন করবে এটাই  প্রত্যাশা করে।
(লেখক একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কলামিস্ট)।