- হাসিনা আকতার কোহিনুর -

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে কিছু বলতে চাই।
আমরা চাটগাঁইয়ারাই আমাদের আঞ্চলিক ভাষাকে সম্পূর্ণ নড়বড়ে করে ফেলেছি। অথচ আমাদের ভাষাটি স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ভাষা। ছোট বেলা থেকেই জেনে এসেছি, দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং উত্তর চট্টগ্রামের মধ্যে ভাষাগত একটা পার্থক্য আছে। 
যেমন- 
'শুটকি' মাছকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোকজন বলেন 'ঊঁনি মাছ' আর উত্তর চট্টগ্রামের লোকজন বলেন 'ফুনি মাছ'। 

'করেছে' শব্দটার পার্থক্য দক্ষিণ চট্টগ্রামে 'গইরগে'। উত্তর চট্টগ্রামে 'গইজ্জে'।

'খড়ের গাদা' শব্দটার পার্থক্য দক্ষিণ চট্টগ্রামে 'কুইরগা'। উত্তর চট্টগ্রামে 'কুইজ্জা'।

'খেয়েছি' শব্দটার পার্থক্য দক্ষিণ চট্টগ্রামে 'হাইয়্যি'। উত্তর চট্টগ্রামে 'হাই'।

'শুনেছি' শব্দটার পার্থক্য দক্ষিণ চট্টগ্রামে 'উন্নি'। উত্তর চট্টগ্রামে 'ফুন্নি'।

"বুড়া খড়ের গাদা থেকে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নদীতে পড়ে গেছে।" 
দক্ষিণ চট্টগ্রামের ভাষায়- "বুইরগা কুইরগাত তুন পরি গইরগাই গইরগাই দইরগাত পইরগে গই।"
উত্তর চট্টগ্রামের ভাষায়- "বুইজ্জা কুইজ্জাত তুন পরি গইজ্জায় গইজ্জায় দইজ্জাত পইজ্জে গই।"

আমার বাবার বাড়ি দক্ষিণ চট্টগ্রামের "সাতকানিয়া" এবং শ্বশুর বাড়ি "রাউজান" উপজেলার "গহিরা" গ্রামে। সুতরাং গত ৩৫ বছর ধরে এই দুই এলাকার ভাষাগত পার্থক্য শুনেই আসছি। 

ইদানীং আঞ্চলিক ভাষা বাংলা শব্দের সংমিশ্রণে হযবরল হয়ে গেছে। 
যেমন- 
"চিংড়ি শুটকি দিয়ে বেগুন রান্না করেছি।" এটা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলতে হবে, " ইছা ঊঁনি/ ফুনি দিয়েরে বাইয়ুন রাইন্দি।" কিন্তু অনেককে বলতে শুনেছি, "চিংড়ি শুটকি দিয়েরে বেগুন রাইন্দি।" 
"এক্কানা হাই ছঅন" মানে "একটু খেয়ে দেখুন।" আর অনেকে এটাকে এভাবে বলে, "একটু টেস্ট গরন।"

"আমি বাসা থেকে সকালে বের হয়েছি।" 
এটার আঞ্চলিক রূপ- "আঁই বেইন্না ফজরত ঘরত্তুন বাইর অইয়্যি।" 
অনেকে বলে, "আঁই সকালে বাইর অইয়্যি।"

আবার, "আমি ঈদের কেনাকাটা করতে যাচ্ছি।"
এটার আঞ্চলিক রূপ- " আঁই ঈদ্দো বাজার গইত্তাম যাইদ্দি।"
অনেকে বলে, "আঁই ঈদর শপিং গইত্তাম যাইদ্দি।"
বলি, এটা আবার কেমন ভাষা গো!!
আঞ্চলিকও হলো না। সাধু ভাষাও হলো না। 
সব জগাখিচুরি হয়ে গেলো না!

চাটগাঁইয়া আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তি শেফালী ঘোষ আর শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব মারা যাওয়ার পর তাদের গাওয়া হাজার হাজার গানের কথায় বাংলা শব্দ ঢুকে গেছে।  হারিয়ে গেছে অনেক আঞ্চলিক শব্দ। 

আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব অনেকে পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে আছে, তারা ছেলেমেয়েকে চাটগাঁইয়া ভাষাতো দূরে থাক, বাংলা ভাষাটাই শেখায় না! যার ফলে তারা দেশে আসলে কারো কথা বোঝেও না, আবার বলতেও পারে না। ফলে এসব বাচ্চারা কারো সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিশতে পারে না। প্রবাসী মা-বাবারা বাসায় ইংরেজিতে কথা বলে। নিজের আঞ্চলিক ভাষা তারা চর্চা করে না বলেই বাচ্চারাও শিখতে পারে না। এমনকি তারা বাংলা ভাষাটাও জানে না।

এভাবেই আমরা বাংলা, ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে আমাদের এতো সুন্দর গোছানো ভাষাটার বারোটা বাজিয়েই ফেলেছি। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্বয়ংসম্পুর্ণ আঞ্চলিক শব্দ ভান্ডার। 

কথা হলো, যখন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলবো তখন খাস চাটগাঁইয়া ভাষায় বলবো। 
আবার যখন সাধু ভাষায় কথা বলবো তখন শুদ্ধ বাংলা শব্দের সংমিশ্রণে কথা বলবো।

আসুন আমরা আমাদের স্বয়ংসম্পুর্ণ আঞ্চলিক ভাষা মানে আমাদের চাটগাঁইয়া ভাষাকে হারিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাই।