আমাদের দেশে ১৯৯০ সাল থেকে তত্বাবধায়ক সরকারের কনসেপ্ট শুরু হয়। একটি অবাধ,সুষ্ঠু,নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষে সম্মিলিত বিরোধী দলের সংঘটিত নব্বইয়ের সফল গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।

উক্ত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত অবাধ,সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণ মূলক জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে শুরু হয়  গণতন্ত্রের শুভ যাত্রা।জনগণের প্রত্যাশা ছিল দীর্ঘদিনের স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পাবে।সরকার ও বিরোধী দলের সহনশীল আচরণের মাধ্যমে গণতন্ত্র টেকসই ও পরিপক্ব হবে।কিন্তু  রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতারোহনের  পর শুরু হয় দলীয়করণ।অত:পর দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কয়েকটি বিতর্কিত উপ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারো তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের যৌক্তিকতা দেখা দেয়। বিরোধী দলের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধন করে পরবর্তী তিনটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রচলন করে। নানা ঘটনা প্রবাহের পর সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত উক্ত জাতীয় নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত থাকে।তৎকালীন বিরোধী দল ক্ষমতায় গিয়ে সর্বত্রই দলীয় করণ শুরু করে এবং পরবর্তী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য প্রশাসনসহ প্রত্যেক সেক্টরের ২/৩ স্তরে নিজেদের পছন্দের লোককে পদায়ন করে।কিন্তু তত্বাবধায়ক সরকারের তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমানের মেধা,বুদ্ধিমত্তা ও ধীশক্তির কারনে সেটা সম্ভবপর হয়নি।অত:পর ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে জনগণ বিরোধী দলের পক্ষে রায় দেয়।সরকার গঠণের পর আবারো শুরু হয় ক্ষমতাসীনদের দলীয়করণ। পরবর্তী নির্বাচনে জয় লাভের উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশনসহ সর্বত্রই দলীয়করণ ও কূটকৌশল প্রয়োগ করতে দেখা যায়। শুরু হয় আন্দোলন।সর্বত্র নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব হলে জরুরী অবস্থা জারী এবং সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার গঠিত হয়।রাজনৈতিক দলগুলোর দাবী অনুসারে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন,স্বচ্ছ ব্যালেট বাক্সের ব্যবস্থা করে ২০০৮ সালে অবাধ,নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক  জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জন রায়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ।সময়ের পরিক্রমায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিধান সংবিধানে অকার্যকর হলে সরকার উক্ত বিধান পূণরায় অন্তর্ভুক্ত না করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত করে দেয়। ক্ষমতায় থাকলে তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিরুদ্ধে আর বিরোধী দলে বা ক্ষমতার বাইরে থাকলে এ পদ্ধতির পক্ষে যা সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে ক্ষমতার জন্যই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলতে থাকে।
   তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দলীয় সরকারে অধীনে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রহসনের নির্বাচনে বেশিরভাগ সংসদীয় আসনে বিনা ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া, ২০১৮ সালে রাষ্ট্র যন্ত্রকে অনৈতিকভাবে ব্যবহার করে কথিত দিনের ভোট রাতে বিশেষ মার্কায় সীল মেরে বাক্স ভর্তি করা এবং ২০২৪ সালে একতরফা নির্বাচন আয়োজন করে প্রাপ্ত ২৮-২৯%  ভোটকে প্রায় ৪২-৪৩% উন্নীত করে অবৈধভাবে সরকার গঠণ করার রাজনৈতিক খেলা জনগণ অবলোকন করেছে।এ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের মূল্যায়নে অনুমিত হয় যে,তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থকগণও ভোট কেন্দ্রে যায়নি।যেখানে বিশাল জনগোষ্ঠী ভোটাধিকার প্রয়োগে বিরত ছিল সেখানে ভোটার বিহীন উক্ত নির্বাচনের বৈধতা পাওয়ার সুযোগ ছিল না। গৃহীত ভোটের হার স্বল্পতার কারনে সরকার গঠণে সাংবিধানিক বাঁধা না থাকলেও এটা নৈতিকতা বিবর্জিত ছিল।বিবেকবান মানুষের পক্ষে গঠিত উক্ত সরকারকে বৈধ সরকার হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি ছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ সরকার নৈতিক সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়। অনেকে এটাকে ভারত সমর্থিত সরকার হিসেবেও আখ্যায়িত করতে থাকে।মাননীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্র,মানবাধিকার,আইনের শাসন ও জনগণের ভোটাধিকারের জন্য দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছিলেন অথচ ক্ষমতায় গিয়ে তিনি নিজেই স্বৈরাচার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।তাঁর শাসনামলে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়।জনগণের ভোটাধিকারকে তামশায় পরিণত করা,সর্বত্রই দূর্নীতি,অনিয়ম,বিদেশে অর্থ পাচার,বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড,বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ,গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালুর কারনে চরমভাবে মানবাধিকার লংঘন এবং জনগণের মৌলিক অধিকার ও বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়।ক্ষমতার দাপটে তাঁর দাম্ভিকতা ও অহমিকা এত বেশি ছিল যে,তাঁর সরকার বা দলের বিরুদ্ধে কারো কথা বলার সাহস ছিলনা।ছিল না সংবাদ মাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা।তিনি রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত এবং রাস্ট্র যন্ত্রকে ব্যবহার করে ভিন্ন মত দমনে জঘন্য ও নিষ্ঠুরতম পদ্ধতি প্রয়োগ করেন।যার ফলে গত ০৫ আগস্ট  ছাত্র জনতার সংঘটিত গণ অভ্যূত্থানের মাধ্যমে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং তাঁর সরকার ক্ষমতাচ্যূত হয়।

    অবাধ,নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন এবং সুষ্ঠু ও স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমেই জনগণের সরকার গঠণ ও  গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাস্ট্রের স্থিতিশীলতা সম্পূর্ণ নির্ভর করে। দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের অতীত অভিজ্ঞতা একেবারেই ন্যাক্কারজনক।কাজেই অবাধ,নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত ও সকল দলের অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষে আমাদের সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে অন্তর্ভুক্তির দাবী রাখে।একই সাথে সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় নির্বাচনী  আইন,বিধিমালা প্রণয়ন,বিদ্যমান বিধি বিধান সংশোধন,সংযোজন ও পরিমার্জনের আবশ্যকতাও রয়েছে। এ লক্ষে বর্তমান সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এটা জনগণ প্রত্যাশা করে। 

  রাজনীতি দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য।ভোটাধিকার জনগণের অমূল্য সম্পদ।এটি জনগণের উপর ছেড়ে দেওয়াই উত্তম।অতীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনসমূহ উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতো।এসব নির্বাচনে  ভোটাধিকার প্রয়োগে কোন বিতর্ক ছিল না।কিন্তু বিগত সরকার নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আইন করে দলীয়ভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান চালু করায় নানা বিতর্ক সৃষ্টিসহ বিনা ভোটে বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হতে দেখা যায়। এসব কারনে মানুষ ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।জন রায়ের প্রতিফলন ঘটবে না মনে করেই বেশিরভাগ ভোটারদের মধ্যে  ভোটাধিকার প্রয়োগের অনীহা দেখা দেয়।ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের অনুপস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য শুভ লক্ষণ নয়।তাঁরা কেন কেন্দ্র বিমুখ তা সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখার এবং উত্তরণের পথ খুঁজে বের করার আবশ্যকতা রয়েছে।দক্ষিণ এশিয়ায় মধ্যে আমাদের নির্বাচন নিয়ে বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ হয় অথচ নেপাল,
ভুটান এবং পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়েও এরকম বিতর্ক  হতে দেখা যায় না।স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও স্বাধীনভাবে জনগণের মতামত,রায় বা ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি আজও নিশ্চিত করা যায়নি।জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের অশুভ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান।এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য দূর্ভাগ্য।

-লেখক একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কলামিস্ট।