▪ কাজী আয়েশা▪


রাউজান তথা গহিরার কৃতি সন্তান ভাষা সৈনিক  মাহবুব উল আলম চৌধুরী। ভাষার মাসে চট্টগ্রামের শত বছরের পুরনো পাবলিক লাইব্রেরির নাম পরিবর্তন করে একুশের প্রথম কবিতার কবি ও ভাষা সৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নামে রাখা হয়েছে ।

ভাষা সৈনিক  মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জন্ম চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা এলাকার আসাদ চৌধুরী বাড়িতে। তাঁর পিতা আহমদুর রহমান চৌধুরী এবং মাতা রওশন আরা বেগম।

একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীর একাশি বছরের জীবন সংগ্রাম ও সৃজনশীলতায় ভরা এক বর্ণাঢ্য জীবন। এ দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে, সাংস্কৃতিক চেতনার বিস্তরণে এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির সাধনায় তাঁর ভূমিকা ছিল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ও সংগঠকের।
তরুণ বয়সে মাহবুব উল আলম চৌধুরী ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিক্ষরা দিনগুলোকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সমাজতন্ত্রের সাড়া জাগানো ভাবাদর্শের প্রভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। প্রণোদিত হয়েছিলেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের জীবনে সোনালি ভবিষ্যৎ রচনার সংগ্রামী মন্ত্রে। এ সবই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল বামপন্থি আন্দোলনে শামিল হতে।
ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্ররাজনীতির সংস্পর্শে এসেছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে। ক্রমেই হয়ে উঠেছিলেন বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় কর্মী এবং বামপন্থি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তিনি রাজনীতির গণ্ডিতেই কেবল জীবনকে আবদ্ধ রাখেননি। বরং দীর্ঘ কর্মজীবনে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মধ্যে মেলবন্ধন রচনায় সচেষ্ট ও ব্রতী হয়েছিলেন।
মাহবুব উল আলম চৌধুরীর প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ কাজ প্রগতিবাদী সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ। তিনি চল্লিশের দশকের শেষভাগে  সুরচিত চৌধুরীর সঙ্গে যৌথভাবে  সম্পাদনা করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত প্রথম প্রগতিশীল মাসিক সাময়িকপত্র ‘সীমান্ত’ (১৯৪৭-১৯৫২)। এর  প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় কার্তিক ১৩৫৪ বঙ্গাব্দে। এর প্রচ্ছদে পশ্চিমবঙ্গের প্রধানমন্ত্রী প্রফুলচন্দ্র ঘোষের অভিমত ছাপা হয়। ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার’, ‘যুগান্তর’ ইত্যাদি পত্রিকায় তখন ‘সীমান্ত’ পত্রিকার উচ্ছ¡সিত প্রশংসা ছাপা হয়। ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং বঙ্গ সরকারের তদানীন্তন মন্ত্রী মুহম্মদ হাবীবুল্লাহ বাহার প্রমুখ ‘সীমান্ত’কে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। উন্নতমানের সুসম্পাদিত ঐ পত্রিকাটি অসা¤প্রদায়িক প্রগতি চেতনার ধারক ও বাহক হিসেবে পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছিল।
১৯৫০ সালে কায়েমি সাম্প্রদায়িক শক্তির প্ররোচনায় অনভিপ্রেত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। চট্টগামের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা দাঙ্গা প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিকদের উদ্যোগে জে এম সেন হলে দাঙ্গা প্রতিরোধে সমাবেশ হয়। পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী এক মিছিল হয়। মিছিলে শিল্পীরা দাঙ্গাবিরোধী গান গেয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। মাহবুব উল আলম চৌধুরী সে সময়ে  দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। তা ছাড়া তিনি ‘সীমান্ত’ পত্রিকার দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যাও প্রকাশ করেন। এভাবে তিনি তখন সামাজিক দায়বদ্ধতাকেই ভাস্বর করে তুলেছিলেন।
পঞ্চাশের দশকের গোড়াতেই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সা¤প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐ অবস্থা মোকাবেলার লক্ষ্যে বামপন্থিরা প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলাকে আশু করণীয় হিসেবে বিবেচনা করেন। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৫১ সালের ১৬-১৯ মার্চ চট্টগ্রামের হরিখোলার মাঠে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন তখনকার পূর্ব বাংলায় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে এবং বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল। মাহবুব উল আলম চৌধুরী  সম্মেলন উদযাপন পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়।
১৯৫০ সালের প্রথম দিকে গণনাট্য আন্দোলনের ভাবধারায় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ। হরিখোলার মাঠে সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠান থেকে প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ গণনাট্যের আদর্শে নাটক মঞ্চায়ন শুরু করে। এই সংঘ প্রতিষ্ঠায় ও এর কর্মকাণ্ডে যাঁরা মূলত উদ্যোগী ও তৎপর ছিলেন তাঁদের মধ্যে মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন অগ্রণী।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন দৃঢ়চিত্ত ভাষাসৈনিক। ১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে ভাষা আন্দোলনে কেবল নেতৃত্ব দেননি, নিজের কবিচেতনাকেও অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগিয়েছিলেন। রোগশয্যায় শুয়ে লিখেছিলেন, ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র মতো উত্তাল আবেগময় অবিস্মরণীয় কবিতা। চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর মুদ্রণালয় কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ঐ কবিতার হাজার হাজার কপি গোপনে ছাপানো হয়েছিল। অসুস্থতার কারণে মাহবুব উল আলম চৌধুরী সে কবিতা লালদীঘির জনসভায় নিজে পাঠ করতে পারেননি। জনতার সামনে ঐ কবিতা পাঠ করেছিলেন বামপন্থি রাজনীতিক চৌধুরী হারুনর রশীদ। কবিতাটির অসামান্য শক্তিতে ভীত হয়ে পাকিস্তান সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কোহিনূর প্রেসে তল্লাশি করে কবিতার কপি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এ এখন এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
পঞ্চাশের দশকের রাজনৈতিক অঙ্গনে মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন সক্রিয় কর্মী, সংগঠক ও নেতা। ১৯৫৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠেয় পূর্ব বাংলার আইনসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে এর আগে ক্ষমতাসীন সা¤প্রদায়িকতাবাদী মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির একটি যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠেছিল। ঐ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়।  মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রামে ঐ যুক্তফ্রন্টের কর্মী শিবিরের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন।  এ থেকে ঐ সময়ে তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকা ও অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর পরই ১৯৫৪ সালের ১৯ এপ্রিল ঢাকার কার্জন হলে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্মেলনে। চট্টগ্রাম থেকে শতাধিক শিল্পী-সাহিত্যিকের একটি প্রতিনিধি দল ঐ সম্মেলনে  যোগদান করে। মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন তার দলনেতা। এতে সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে তাঁর সক্রিয় ভূমিকার প্রমাণ মেলে।
মুসলিম লীগের ভরাডুবি এবং পূর্ব বাংলায় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ক্রমিক বৃদ্ধি পাকিস্তানি কায়েমি শাসক গোষ্ঠীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের হীন উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৪ সালের ২০ মে গণতন্ত্র ও প্রগতি বিরোধী ৯২ (ক) ধারা জারি করে এবং এর মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন কায়েম করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কর্মীদের ওপর প্রচণ্ড দমন নীতি আরোপ করা হয়। ফলে প্রান্তিক নবনাট্য সংঘের কর্মতৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও অন্যান্য সংগঠক এই সময় আত্মগোপনে চলে যান। পরে ১৯৫৫ সালে কৃষ্টিকেন্দ্র নামে নতুন সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলা হয়। মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন কৃষ্টিকেন্দ্রেরও নেপথ্যচারী প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা। এভাবেই ব্যাপক কর্মতৎপরতার মাধ্যমে চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পূর্ব বাংলার একজন অগ্রণী সাংস্কৃতিক সংগঠক।
রাজনীতি-সচেতন সাংস্কৃতিক কাজে বিপুল ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝেমধ্যে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর লেখালেখি অব্যাহত থেকেছে। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কবিতার সংখ্যাই বেশি। ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ (১৯৮৮) তাঁর  সাড়া জাগানো কাব্যগ্রন্থ। এর আগে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেগুলো হলো : চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘আবেগধারা’ (১৯৪৪), কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘ইস্পাত’ (৯৪৫) ও ‘অঙ্গীকার’ (১৯৪৬)। শেষ জীবনে লেখা তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে : ‘সূর্যাস্তের রক্তরাগ’ (২০০৪), ‘সূর্যের ভোর’ (২০০৬), ‘গরাদ ভাঙার সংগ্রামীরা জাগো’ (২০০৭), ‘অদর্শনা’ (২০০৮), ‘ক্লান্ত বাঁশির সুর’ (২০০৮), ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে’ (২০০৮)। এ ছাড়া ‘ভাঙন’ (১৯৪৩), ‘দারোগা’ (১৯৪৪) ও ‘আগামীকাল’ (১৯৫৩) নামে তিনটি নাটক এবং ‘বিষের নেশা’ (১৯৪৬) নামে একটি উপন্যাস তিনি লিখেছিলেন। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘বিপ্লব’ নামের পুস্তিকাটি তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৫৬ সালে ‘মিশরের মুক্তিযুদ্ধ’ নামে আর একটি পুস্তক চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। শিশু-কিশোরদের জন্য ‘ছড়ায় ছড়ায়’ নামের একটি বই কিছুকাল আগে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : ‘সংস্কৃতি : জাতীয় মুখশ্রী’ (২০০৬), ‘আলোর সন্ধানে দেশ’ (২০০৮), ‘সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি’ (২০০৮)।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী সত্তরের দশকে সম্পাদনা করেছেন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক স্বাধীনতা’ (১৯৭২-১৯৮২)। এটি সাংবাদিক হিসেবে তাঁর ভূমিকার পরিচায়ক।
কর্মকৃতির জন্য ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি তাঁকে সম্মাননাসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। ২০০১ সালে তাঁকে একুশে পদক ও সংবর্ধনা প্রদান করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এ ছাড়া তিনি ঢাকা এবং চট্টগ্রামে স্বর্ণপদকসহ বহু সংবর্ধনা লাভ করেছেন।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী আমৃত্যু অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী চিন্তা-চেতনার মশাল বয়ে গেছেন। ২০০৭ সালের প্রান্তিকে এসে গত ২৩ ডিসেম্বর একাশি বছর বয়সে তিনি মাটি ও মানুষের মায়া কাটিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। অবসান হয়েছে তাঁর বর্ণাঢ্য, কর্মময় ও সংগ্রামী জীবনের।
মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জীবন ও চিন্তা, কর্ম ও অবদান আমাদের কাছে প্রেরণা-উজ্জীবক। একুশের প্রথম কবিতার এই কবির নাম বাংলার  ইতিহাস ও বাঙালির হৃদয় থেকে মুছে যাওয়ার নয়।