চট্টগ্রামের হাজী মহসিন খ্যাত প্রখ্যাত দানবীর মরহুম আলহাজ্ব ছৈয়দ আবদুল অদুদ চৌধুরী ছিলেন সৎ,সদালাপী,সমাজ হিতৈষী,নিরহংকার ও ধর্মভীরু একজন মহান মানুষ।ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত হালাল আয়ে একক অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা করেন একাধিক স্কুল,মাদ্রাসা,মসজিদ,সড়কসহ অনেক লোকহিতৈষী প্রতিষ্ঠান।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহের নাম নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ-
(১) ফতেনগর নোয়াজিশপুর অদুদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়;
(২)ফতেনগর নোয়াজিশপুর ফাজিল মাদ্রাসা;
(৩) ফতেনগর অদুদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়;
(৪) হাটহাজারী অদুদিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ;
(৫)চন্দ্রঘোনা অদুদিয়া তৈয়্যবীয় ফাজিল মাদ্রাসা;
(৬)গাহিরা- আজাদী বাজার অদুদিয়া সড়ক এবং
(৭) বিভিন্ন স্কুল,কলেজ,মাদ্রাসা  বিশ্ববিদ্যালয় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য অংকের আর্থিক অনুদান এবং প্রান্তিক ও সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে অর্থ সহায়তা প্রদান।

      তিনি ১৯০৭ সালে নোয়াজিশপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।শৈশবকাল থেকেই তাঁকে কঠোর পরিশ্রম ও সংগ্রামের মধ্যেই গড়ে উঠতে হয়েছে।ব্যবসাকে তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন।সততা,স্বচ্ছতা,কঠোর শ্রম,কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার কারনে তিনি পেশাগত জীবনে আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করেন।হালালভাবে উপার্জিত অর্থ ব্যয় করে শিক্ষার প্রসার,মানবকল্যাণ ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন।সে সময়ে নোয়াজিশপুর,ফতেনগর,নদিমপুর,পার্শ্ববর্তী আবদুল্লাহপুর ও চিকদাইর অঞ্চলে কোন উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা না থাকায় ছেলে-মেয়েরা শিক্ষা সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল।উক্ত অঞ্চলসমূহে শিক্ষার প্রসার ও জনকল্যাণের প্রত্যয়ে এবং সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য তিনি নিজ অর্থায়নে একটি উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের অকৃত্রিম সাহায্য- সহযোগিতায় ১৯৬৩ সালে ফতেনগর নোয়াজিশপুর অদুদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন।উক্ত বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে উল্লিখিত অঞ্চলসমূহে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং বিদ্যালয়টিও উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়।এ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,সরকারি চাকরিজীবী,চিকিৎসক
প্রকৌশলী,আইনজীবী,শিক্ষাবিদ,
সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী হিসেবে স্ব-স্ব পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত। আধুনিক রাউজানের স্থপতি,
রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাননীয় সভাপতি জননেতা জনাব এ,বি,এম ফজলে করিম চৌধুরী,এম,পি মহোদয়ের আন্তরিক সহযোগিতায় ১৫ নম্বর নোয়াজিশপুর ইউনিয়ন পরিষদের সুযোগ্য চেয়ারম্যান এবং বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি জনাব আলহাজ্ব মোহাম্মদ সরোয়ার্দী শিকদারের সুষ্ঠু পরিচালনা,তত্ত্বাবধান ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে বিদ্যালয়টি রাউজান উপজেলার অন্যতম একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।ইতোমধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিদ্যালয়টির শতভাগ পরীক্ষার্থী কৃতকার্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়নও দৃশ্যমান।এটা এখন এলাকাবাসীর গর্বের প্রতিষ্ঠান।আগামীতে বিদ্যালয়টিকে কেন্দ্র করে একটি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হোক এটাই এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম প্রত্যাশা।শিক্ষা প্রসারে মরহুম ছৈয়দ আবদুল অদুদ চৌধুরী যে আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন বর্তমানে তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে একটি বৃহৎ অঞ্চলকে আলোকিত করছে।তিনি একক অর্থায়নে চট্রগ্রামের বিভিন্ন স্থানে  একাধিক মাদ্রাসা,এতিমখানা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছেন। অনাথ,এতিম ও সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সন্তানগণ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সুশিক্ষা ও খাদ্য সহায়তা গ্রহণ করে গড়ে উঠার সুযোগ পাচ্ছে।
      তৎকালীন সময়ে ফটিকছড়ির আজাদী বাজার থেকে রাউজানের গহিরা পর্যন্ত যাতায়াতের কোন রাস্তা বা সড়ক ছিল না।ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে কৃষি জমির উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে গহিরায় গমন করে চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি  শহরে যাতায়াত করতে হতো।জনসাধারণের যাতায়াত সমস্যা নিরসনে তিনি আজাদী বাজার থেকে গহিরা পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।কিন্তু কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন।ব্যক্তি মালিকানাধীন সহস্রাধিক একর জমি কিনে সড়কটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা ছিল খুবই দুরূহ।জমি মালিকদের অনেকেই জমি প্রদানের স্বতঃস্ফূর্ততা থাকলেও আবার অনেকের অপারগতা এবং অসম্মতিও ছিল।কিন্তু সকল বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সম্পূর্ণ নিজ অর্থায়নে জমি ক্রয় করে গহিরা-আজাদী বাজার অদুদিয়া সড়কটি নির্মাণ করতে সমর্থ হন।উক্ত সড়কটি নির্মাণে তিনি জমি মালিকদের কাউকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে সংশ্লিষ্টদেরকে  উপযুক্ত ক্ষতি পূরণ প্রদান করেছিলেন।বর্তমানে এ সড়কটি ফটিকছড়ি উপজেলার হেঁয়াকো থেকে রাউজান উপজেলার  গহিরা পর্যন্ত জনসাধারণের চলাচলের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।এটি ফটিকছড়ি ও রাউজান উপজেলার মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবেও কাজ করছে।
পরবর্তীতে  ফটিকছড়ি উপজেলার আরো কতিপয় এলাকার জনসাধারণের ব্যবহারের সুবিধার্থে সরকার সড়কটিকে অধিগ্রহণ করে  ফটিকছড়ির হেঁয়াকো পর্যন্ত সম্প্রসারণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।ক্রমান্বয়ে সড়কটি ব্যবহারের গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উহার প্রশস্ততা বৃদ্ধি,মেরামত,
নবায়ন ও আধুনিকায়নের আবশ্যকতা দেখা দেয়।যার ফলশ্রুতিতে জননেতা জনাব এ,বি,এম ফজলে করিম চৌধুরী,এম,পি মহোদয় এবং নোয়াজিশপুর ইউনিয়ন পরিষদের সুযোগ্য চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোহাম্মদ সরোয়ার্দী শিকদারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সরকার কর্তৃক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।গৃহীত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমানে সড়কটির প্রশস্ততা বৃদ্ধিসহ নবায়ন ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে এটিকে একটি আধুনিক সড়কে রুপান্তরিত করা হয়েছে।গুরুত্বপূর্ন এ সড়ক ব্যবহার করে ফটিকছড়ি ও রাউজান উপজেলার বেশ কিছু অঞ্চলের মানুষের পক্ষে চট্রগ্রাম, রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলার সাথে সহজভাবে ও স্বল্প সময়ের মধ্যে  যোগাযোগ এবং যাতায়াতের  সুবিধা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। উল্লিখিত অঞ্চলসমূহের জনসাধারণের দ্রুত যাতায়াত,পণ্য পরিবহন ও পরিসেবা,ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার এবং জীবন যাত্রার মানোন্নয়নে সড়কটি উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখছে।মরহুম আবদুল অদুদ চৌধুরী মানব কল্যাণের যে স্বপ্ন লালন করে কাজ করেছিলেন তা প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি  প্রতিষ্ঠান সমাজ তথা দেশের বিনির্মানে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখছে। ব্যক্তিগত জীবনে এ মহান মানুষটি অত্যন্ত সাদাসিধা জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। নিরহঙ্কার ও সাদা মনের এ  মহৎ ব্যক্তির  নিকট ধনী গরীবের কোন বিভাজন ছিল না।মানব সেবা,মানব কল্যান,মানব প্রেম ছিল তাঁর একমাত্র স্বপ্ন যা তিনি কর্মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করছেন।
    ২৪ নবেম্বর,১৯৭১ মহান দানবীর আলহাজ্ব ছৈয়দ আবদুল অদুদ চৌধুরী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরকালে চলে যান। ৫২তম মৃত্যু বার্ষিকীতে পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এ মহান দানবীরকে।তাঁর জনহিতকর মহান সৃষ্টিসমূহ চিরন্তন।এগুলো থেকে মানুষ আজীবন উপকৃত হবে এবং তাঁকে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রাখবে। তিনি কর্ম,মানব প্রেম,উদারতা ও সৃজনশীলতার জন্য মানুষের কাছে অগাধ শ্রদ্ধা ও অপরিসীম ভালোবাসায় যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন।আল্লাহ পাক পরোপকারী এ মহান মানুষকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। মরহুমের ৫২তম মৃত্যুবার্ষিকী ব্যাপক পরিসরে উদযাপন উপলক্ষে স্থানীয় নোয়াজিশপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব আলহাজ্ব এম.সরোয়ার্দী শিকদারের নেতৃত্বে গণমান্য ব্যক্তিবর্গ ও এলাকাবাসীর সার্বিক সহায়তায় রাউজানের নোয়াজিশপুর গ্রামে মরহুমের কবর জেয়ারত,পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ,তাঁর কর্ম ও জীবন নিয়ে আলোচনা,স্মরণিকা প্রকাশ এবং মেজবানের আয়োজন করা হয়েছে। 
 

লেখকঃ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কলামিষ্ট।