চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান, শিক্ষাবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের সংগঠক অধ্যাপক আলহাজ্ব আহমদ হোসেন ১৯২৮ সালের ৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত হাটহাজারী থানার গড়দুয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
    মরহুম অধ্যাপক আহমদ হোসেন ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামের নিখিল পূর্ব পাকিস্থান ছাত্র সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। এই সম্মেলনের প্রধান অতিথি ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
    ১৯৬১ সালের ৭ মে চট্টগ্রামে তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে যে কমিটি গঠন করা হয় সেখানে মরহুম বাদশা মিয়া চৌধুরীকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংগঠনিক পরিষদের সভাপতি ও অধ্যাপক আহমদ হোসেনকে আহবায়ক নির্বাচিত করা হয়। এই পরিষদের আহবায়ক হিসেবে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিকে তিনি জনপ্রিয় করে তোলেন। পরিষদের পক্ষে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, গভর্নর ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস্যদের স্মারকলিপি প্রদানের জন্য বেশ কয়েকবার করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও লাহোর সফর করেন।
    তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক ও সংস্কৃতিমনা মানুষ।  ১৯৬৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের সম্পাদক ছিলেন। পাকিস্থান থেকে স্বাধীন হওয়ার প্রত্যয়ে ১৯৬০ এর দশকেই ছাত্র জনতার মধ্যে একটা প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক মনোভাব তৈরি হয়েছিল-তিনি ছিলেন চট্টগ্রামে এই আন্দোলনের পুরোধা। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে তাঁর রচিত গীতি নাটক ‘আমাদের মুক্তিসংগ্রাম” আমার পরিচালনায় প্রদর্শিত হয়েছিলো কয়েক স্থানে। এই গীতি নাটক গুলো ১৯৭১ এ মুক্তি পাগল বাঙালী জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি কবিয়াল রমেশ শীলকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ রচনা লিখেছিলেন।
    ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সিটি কলেজের সহ অধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক আহমদ হোসেনের সবচেয়ে বড় কাজ আইস ফ্যাক্টরি রোডে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি মহিলা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। সেই সময় সিটি কলেজের পাশে পরিত্যক্ত ভবনে মহিলা বিদ্যালয়টি করার প্রচেষ্টা শুরু করেন-যেটি আজ মহিলা মহাবিদ্যালয় হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে ।
    তিনি তাঁর নিজগ্রামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়টির নাম ড. শহীদুল্লাহ একাডেমী। মানুষ সাধারণত নিজের নাম বা নিজের মা, বাবার নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করে থাকেন। কিন’ অধ্যাপক আহমদ হোসেন শিক্ষকের নামে বিদ্যালয়ের নাককরণ করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।     অধ্যাপক আহমদ হোসেন স্যার ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ইকবাল হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। বাঙলা সাহিত্য তার বিষয় ছিল। সেই সময়ের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ওয়াদা করেছিলেন পায়জামা পাঞ্জাবী পড়বেন-আমৃত্য এই পোশাক ছাড়া অন্য কোণো বিজাতীয় পোশাক বা সংস্কৃতি তিনি ধারণ করেননি। আপাদমস্তক বাঙালী ছিলেন তিনি। মরহুম অধ্যাপক আহমদ হোসেন ছিলেন সংস্কৃতিমনা ও রাজনীতি সচেতন একজন শিক্ষক। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশকে স্বাধীন করতে ছাত্র শ্রমিক জনতা সবাই উন্মুখ। আর তখনকার দিনে চট্টগ্রামে আজকের মত এত কলেজ ছিল না। তখন সিটি কলেজ ছিল ছাত্রনেতাদের মিলনস্থল, আন্দোলনের সংগ্রামের ঠিকানা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অংশগ্রহণকারী ছাত্রনেতাদের প্রায় সবাই সিটি কলেজের ছাত্র ছিলেন-আজকের দিনে যারা চট্টগ্রামে ও পরবর্তীতে সারাদেশে আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
    তিনি আমাদের প্রতিবেশী ও শ্রদ্ধেয় মুরব্বী ছিলেন-তার কনিষ্ঠ সন্তান চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা হাসান মনসুর ছিল তৎসময়ে অর্থ্যাত ১৯৮০-৯০ দশকে আমাদের অতিপ্রিয় ছাত্রলীগ নেতা। বন্ধুপ্রতিম হাসান মনসুরের সাথে একরকম পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল-এই রাজনৈতিক যোগসূত্রে। তাদের মেহেদিবাগ শহীদ মির্জা লেইনের বাড়ীটি ছিল আমাদের এলাকাভিত্তিক সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকাÐের বিশ্বস্ত ঠিকানা। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থীর পক্ষে তাদের বাসাকেই বানিয়ে ফেলা হতো-নির্বাচনী পরিচালনা, পরিকল্পনা ও আড্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে। মরহুম  অধ্যাপক সাহেব-চলাফেরা, কথাবার্তায় মানুষকে কখনো কষ্ট দেননি। তার মুখ থেকে কটু কথা কেউ শুনেনি। অবশ্য তিনি খুব অল্প বয়সেই হাঁপানি, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনী সমস্যায় ভুগতে শুরু করেছিলেন। আমৃত্যু তিনি তার রোগ ব্যাধি নিয়ে কাটিয়ে ছিলেন। তাই রাজনৈতিক, সাৎস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারতেন না-শারীরিক অসুস্থতার জন্য।
    অধ্যাপক আহমদ হোসেন ১৯৯৫ সালের ১৬ নভেম্বর মুত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার স্মরণে নাগরিক শোক সভার আয়োজন করা হয়েছিল-যাতে উপস্থিত ছিলেন তারি প্রিয় ছাত্র সাবেক মন্ত্রী এম. এ মান্নান, তৎকালীন মেয়র মরহুম এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সহ পুরো চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও গুনি জনেরা  উল্লেখ্য আমি এই নাগরিক শোক সভা কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে উক্ত সভাটি পরিচালনা করেছিলাম। নিরহংকারী, প্রগতিবাদী, সমাজ সংস্কারক, ত্যাগী এবং বিনয়ী এই গুণী এই শিক্ষাবিদ বাংলাদেশের কীর্তিমান মানুষদের একজন। ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে এই মানুষটি-থাকবেন হৃদয়ে, মর্যাদার আসনে ।


লেখকঃ এম.আর.আজিম
সাবেক সভাপতি, চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ