ইমরান ইমু

জীবন যুদ্ধে কেউ জয়ী হয়, কেউবা আবার ধৈর্য্য হারিয়ে খুব সহজেই হেরে যায়। অনেকে আবার এ জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যায় যে পর্যন্ত জয়ী না হতে পারে। জীবন নামের যুদ্ধে জয়ী হওয়াটা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ যুদ্ধে জয়ী হতে হলে ধৈর্য্য ও মনোবল ধরে রাখা সবচেয়ে জরুরী। জীবন যুদ্ধে দুই যুগ সংগ্রাম চালিয়ে  ফেরদৌসী ভুঁইয়ার গল্পে ফিরেছে ‘ বিজয় মুকুট’ ।

ফেরদৌসী ভুঁইয়ার বয়স তখন মাত্র ৩৫ বছর। স্বামী – সন্তান নিয়ে ছোট্ট সুখের সংসার এই নারীর ।খুব অল্পেই তুষ্ট ছিলেন জীবনে। তবে বেশ স্বপ্ন বিলাসী এবং পরিশ্রমী ছিলেন মানুষটি । হঠাৎ একদিন সব কিছু ভেঙ্গে দিয়ে দেবতাতুল্য স্বামী আক্রান্ত হয়ে পড়েন দুরারোগ্য ব্যাধিতে।কোথাও কোন ডাক্তার,কিংবা হাসপাতাল রোগই নির্ণয় করতে পারছিলেন না। বড় মেয়েটা বাবার কষ্ট দেখে সহ্য করতে পারে না। মনে মনে সংকল্প করে, বড় হয়ে ডাক্তার হবে। এভাবে কোন রোগীকে কোন দিন কষ্ট পেতে দেবে না।

মরন ব্যাধি নিয়ে নেয় পুরো পরিবারের সমস্ত সুখ,মুহুর্তেই ভেঙ্গে যায় সব স্বপ্ন। স্ত্রী’র প্রতি মৃত্যু শয্যায় স্বামীর শেষ কথাটি ছিলো ‘ আমার ছেলে মেয়েগুলোকে দেখে রেখো, তোমার হাতে ওদেরকে রেখে গেলাম” —ব্যস,এইটুকুন। ‘

লাশ তখনও দাফন হয়নি, বাইরে থেকে একজন নিকট মুরুব্বী আত্মীয় জরুরী খবর পাঠালেন ঘরে থাকা যাবতীয় গয়না; সব একটা প্যাকেট করে উনাদেরকে দিয়ে দিতে হবে।

শোকে হতবিহ্বল এই মা তখন দিগ্বিদিক, জ্ঞানশূন্য ! মুরুব্বির হুকুম শুনামাত্র তামিল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সারাজীবন পরম যত্নে আগলে রাখা সমস্ত সঞ্চয় একত্র করে একটা প্যাকেট করার জন্য রেডি হলেন। হঠাৎ রুমে বড় মেয়ে নুর নাহার ভূইয়া এসে ডুকলো।

-কি করছো মা?
-এগুলো দিয়ে দিতে হবে ওদেরকে।-কী!  কেন? পাগল হয়ে গেলে? ওরা বললেই হলো?

শুনো,মা… আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে, শক্ত থাকতে হবে.. একদিন আমরাও অনেক বড় হবো ইনশা’আল্লাহ। শুধু আমাদেরকে শক্ত থাকতে হবে, সজাগ থাকতে হবে, আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে। এই বলে সবকিছু গুছিয়ে জায়গা মতো রেখে দেয় মেয়েটা….জীবনযুদ্ধের শুরু এখানেই।

এবার শুরু হলো স্বামীর রেখে যাওয়া জায়গা জমিন নিয়ে টানপোড়ন।অসহায় নারী, বাচ্চাগুলো ছোট…. এদের তো কোন ক্ষমতাই নাই… এই ভেবে যে যেমনে পারলো, জমির বেদখল শুরু করে দিলো। সদ্য স্বামী হারানোর ওই মাকে আদালতের স্মরণাপন্ন হতে হয়। প্রথম বছরেই ২টা টা মামলা দায়ের করেন তিনি আদালতে । ক্ষমতাবানরা ভুলেই গিয়েছিল মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আধিপত্য। আল্লাহর অশেষ কৃপায় দুইটা মামলাতেই বিজয়ী হন এই মা।

একসময় ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা ও অন্যান্য খরচ চালানোর জন্য জমি জমা বিক্রির প্রয়োজন পড়ে। এখানেও বিপত্তি!! জায়গা বিক্রির জন্য আয়োজিত বৈঠকে মা তাঁর ১৩বছর বয়সী একমাত্র পুত্র সন্তান জামীকে পাঠান মায়ের প্রতিনিধিত্ব করতে।সেখানে উপস্থিত থাকে দালাল এবং ক্রেতাপক্ষ বেশ তাচ্ছিল্যের সাথে এক দালাল বাচ্চা ছেলেটাকে বলে

– তুমি ছোট মানুষ।এখানে তোমার কি কাজ? চলে যাও….!!!

জামির মনে দাগ কাটে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় বড়ো হয়ে একদিন আইনজীবী হবে। আর কেউ কোনদিন এভাবে কোন মজলিস থেকে তুলে দিতে পারবে না!যেভাবে আজ তাকে নিজের জমি বিক্রির আলোচনা থেকে সরিয়ে দেয়া হলো!!

নাবালক বাচ্চার পক্ষে জমি বিক্রি করতে হলে দরকার হয় সাকসেশন সার্টিফিকেট। সেটা যোগাড় করার জন্য প্রতিদিন স্কুল থেকে বাচ্চার এডভান্স ছুটি নিয়ে আদালতে যেতে হতো।  বাংলাদেশের আইনী ব্যবস্থাপনা এতটাই ধীর প্রক্রিয়া যে, ওই সার্টিফিকেট তুলতে তুলতে বাড়ির সবচেয়ে ছোট মেয়েটাও সাবালক হয়ে যায়। সাকসেশন সার্টিফিকেটের আর প্রয়োজন পড়ে নি।

সেই মা’ই একসময়   নিজের ছেলে মেয়েদের পৌঁছে দেন সাফল্যের শীর্ষ চূড়ায়।  এভাবে শত সহস্র বাধা বিপত্তি পার করতে করতে দীর্ঘ ২২বছর পাড়ি দিয়ে আজও লড়ে যাচ্ছেন তিনি।

বাবার মৃত্যুর সময় ছোট মেয়ে কামরুন নাহার এতোটাই ছোট ছিলো যে, মৃত্যু ব্যাপারটাই তখন তার বোধগম্য হয়ে উঠেনি। দিনের পর দিন অপেক্ষা করে যায়, একদিন বাবা কবর থেকে উঠে ফেরত চলে আসবে। সেই ভুল ভাঙতে তার বহু বছর সময় কেটে যায়। কিছুটা বুদ্ধি হওয়ার পর জানতে পারে বাবার শেষ স্বপ্ন ছিলো বাচ্চাদেরকে একটা বাড়ি করে দিয়ে যাবে… অসুস্থ অবস্থায় সব আত্মীয়দের কাছে একটা বাড়ির প্ল্যান চেয়ে বসতেন। সেই থেকে বাবার স্বপ্নের বাড়িটার প্ল্যান তৈরী করার জন্য আর্কিটেক্ট হবার প্রত্যয় বেছে নেয় সে।সমস্ত ঝড় ঝঞ্জাটের মধ্যে তিনটি সন্তানকে যথাক্রমে ডাক্তার ( ডা: নুর নাহার) আইনজীবী (  এইচআর নাজিম ভুঁইয়া) প্রকৌশলী ( কামরুন নাহার)।

সন্তানদের একজনকে  ডাক্তার, একজনকে এডভোকেট এবং অন্যজনকে আর্কিটেক্ট বানাতে সক্ষম হন। জীবনের ৫৭ বছর  শেষে। ছেলেমেয়েদের সাফল্যেই তার সব প্রাপ্তির ঢেঁকুর ।  জীবন যুদ্ধে জয়ী এই মায়ের বেঁচে থাকার প্রেরণা।