চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র লালদিঘী মাঠে প্রতি বছর ১২ বৈশাখ "জব্বারের বলীখেলা এবং বৈশাখী মেলা" অনুষ্ঠিত হয়। এই বলীখেলা এক ধরণের 'কুস্তি'। আমাদের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় যা "বলীখেলা" নামে পরিচিত। যারা বলীখেলায় অংশগ্রহণ করে তাদেরকে "বলী" নামে আখ্যায়িত করা হয়। আগামী পরশুদিন ২৫ এপ্রিল' ২০২৪ ইংরেজী, ১২ বৈশাখ' ১৪৩১ বাংলা রোজ বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটায় লালদিঘী মাঠে জব্বারের বলীখেলা অনুষ্ঠিত হবে। তবে আগামীকাল ২৪ এপ্রিল' ২০২৪ ইংরেজি, ১১ বৈশাখ' ১৪৩১ বাংলা বুধবার বৈশাখী মেলা শুরু হচ্ছে। 

১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের "বদরপাতি" এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী "আবদুল জব্বার সওদাগর" এই প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা "জব্বারের বলীখেলা" নামে পরিচিতি লাভ করে। এটি একটি জনপ্রিয় এবং ঐতিহ্যমন্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। এই বলীখেলাকে কেন্দ্র করে আন্দরকিল্লার মোড় থেকে লালদিঘীর চারপাশ, হযরত আমানত শাহ (রঃ) এর দরগাহ্ ছাড়িয়ে জেল রোড, দক্ষিণে বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়িয়ে কোতোয়ালির মোড় এবং পশ্চিমে সিনেমা প্যালেস পর্যন্ত প্রায় ৩/৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে "বৈশাখি মেলা" র আয়োজন হয়। এই মেলা বৃহত্তর চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বৈশাখি মেলা।

বাংলার নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতনের পর এদেশে বৃটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসমাজের মধ্যে বৃটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম শহরের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এই বলীখেলার প্রবর্তন করেন। ব্যতিক্রমধর্মী এই প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য বৃটিশ সরকার জব্বার মিয়াকে "খান বাহাদুর" উপাধিতে ভূষিত করলে তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। বৃটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়া বার্মার 'আরাকান অঞ্চল' থেকেও নামি-দামি বলীরা এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে আসতেন।

চট্টগ্রাম হলো বলীর শহর। কর্ণফুলী এবং শঙ্খ নদীর মাঝামাঝি স্থানে ১৯ টি গ্রামে "মল্ল" উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিলো। তারা যেমন প্রচন্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী ছিলেন, তেমনি সুঠামদেহী সাহসী পুরুষও ছিলেন। তাদের বংশগত পেশা ছিলো শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করা। এই মল্ল বীরেরাই ছিলেন বলীখেলার প্রধান আকর্ষণ এবং বলীখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা। চট্টগ্রামের ২২ টি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। পটিয়ার আশিয়া গ্রামের 'আমান শাহ মল্ল', আনোয়ারার চাতরি গ্রামের 'চিকন মল্ল', বাঁশখালীর কাথারিয়া গ্রামের 'চান্দ মল্ল', পটিয়ার জিরি গ্রামের 'ঈদ মল্ল' ও 'নওয়াব মল্ল', পারি গ্রামের 'হরি মল্ল', পেরলা গ্রামের 'নানু মল্ল', পটিয়ার 'হিলাল মল্ল' ও 'গোরাহিত মল্ল', হাইদগাঁও গ্রামের 'অলি মল্ল' ও 'মুজাহিদ মল্ল', শোভনদন্ডি গ্রামের 'তোরপাচ মল্ল', চন্দনাইশ কাঞ্চননগরের 'আদম মল্ল', ঈশ্বরখাইনের 'গনি মল্ল', সৈয়দপুরের 'কাসিম মল্ল', পোপাদিয়ার 'যুগি মল্ল', খিতাপচরের 'খিতাপ মল্ল', ইমামচরের 'ইমাম মল্ল', নাইখাইনের 'বোতাত মল্ল', আনোয়ারা মাহতার 'ইয়াসিন মল্ল', পটিয়া হুলাইনের 'হিম মল্ল', গৈরালার 'চুয়ান মল্ল' প্রমুখ।

বর্তমানে পেশাদার বলীর অভাবে বলীখেলার তেমন আকর্ষণ না থাকলেও জব্বারের বলীখেলার মূল আকর্ষণ হয়ে উঠেছে "বৈশাখি মেলা"। জব্বার মিয়ার বলীখেলা এবং বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই বলীখেলাকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এই লোকজ মেলায় ফুটে উঠে বাঙালিদের মুন্সিয়ানা। বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং কালচার ফুটে উঠে এই মেলায়। ৩ দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও লালদিঘীর আশেপাশের এলাকা জুড়ে ৫/৬ দিনের জন্য মেলা বসে। এই মেলায় সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসই পাওয়া যায়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কুটিরশিল্পীরা নিয়ে আসেন নানা পণ্য। মাছ ধরার চাঁই, হস্তশিল্প, বেতের তৈরি ডালা-কুলা-চালুনি, তৈজসপত্র, মাটির তৈরি পুতুল, খেলনা, ফুলদানি, টব, তালপাখা, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, মাটির তৈরি বরুনা (ঢাকনা), কাঠ-বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র, হাতপাখা, ফুলের ঝাড়ু, শলার ঝাড়ু, শীতল পাটি, মুড়ি-মুড়কি, নাড়ু-মিঠাই, দা-বটি, গাছের চারা, বৈশাখি ফলসহ নিত্য ব্যবহার্য জিনিস থেকে শুরু করে গৃহসজ্জার সব জিনিস পাওয়া যায় এই মেলায়।

জব্বারের বলীখেলার পাশাপাশি চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে যেমন কক্সবাজারে ডিসি সাহেবের বলীখেলা, সাতকানিয়ায় মক্কার বলীখেলা, আনোয়ারায় সরকারের বলীখেলা, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলীখেলা, হাটহাজারীতে চুরখাঁর বলীখেলা, চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলীখেলা এখনো বিদ্যমান।

জব্বারের বলীখেলার সর্বোচ্চ চ্যাম্পিয়ান "দিদার বলী"। ১৩ বার বিজয়ী হন এই দিদার বলী। বর্তমানে তিনি অবসর নিয়েছেন এই প্রতিযোগিতা থেকে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের আগ্রহের কারণে জব্বারের বলীখেলার প্রচার অনেকাংশে বেড়ে গেছে। বর্তমানে প্রায় সব চ্যানেলে এই বলীখেলা লাইভ দেখানো হয়। শুধু বাংলাদেশে নয়, দেশের বাইরেও ব্যাপকভাবে সম্প্রচার করা হয়। বাঙালিরা যেখানে যে দেশেই থাকুক না কেন তারা আগ্রহের সাথে এই খেলা উপভোগ করে। ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলার ১১৫ তম আসরের সফলতা কামনা করছি।।